Contributors

Sunday, June 14, 2020

প্রথম অরন্য অভিযান

"বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে |"


উপরিউক্ত এই উক্তির সাথে আমরা সকলেই পরিচিত| এই উক্তি বন্যজীবন আর মনুষ্যজীবনের মধ্যেখানে এক বিস্তর ব্যবধান রেখা টেনেছে| শিশুদের মাতৃক্রোড় বা মায়ের কোল কতটা প্রিয় প্রয়োজনীয় তা আমরা সবাই জানি এবং অনুভব করি | তবে "বন্যেরা" বনে কতটা "সুন্দর" তা উপভোগ করার সুযোগ সবার জীবনে ঘটে না| সেই প্রেক্ষ্যিতে বিচার করলে আমি খুব ভাগ্যবতী কারণ জঙ্গলে থেকে বন্য প্রাণের সান্নিধ্যে এসে আমার জীবনের এক অন্যতম সাধ পূরণ হয়েছে |


স্কুল জীবনে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াকালীন জীবনবিজ্ঞানের প্রতি একটা আকর্ষণ জন্মলাভ করে | প্রলুব্ধ করে জীবনবিজ্ঞানের অন্যতম শাখা প্রাণিবিদ্যা| তাই কলজে স্তরে এসে প্রাণীবিদ্যা তথা Zoology নিয়ে ভর্তি হই কলকতার প্রাচীন স্বনামধন্য বিদ্যাসাগর কলেজে | সালটা ছিল ২০১৩, আমাদের দ্বিতীয়বর্ষে শিখ্যামূলক ভ্রমণ তথা Excursion আয়োজিত হয় মহারাষ্ট্রের নাগজিরা ফরেস্ট এবং মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ ন্যাশনাল ফরেস্টে | আমরা গুটিকতক ছাত্রছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকার তত্ত্বাবধানে রওনা দিলাম মহারাষ্ট্রের উদ্যেশে | জঙ্গলের গা ছমছমে রোমহর্ষক অনুভূতির কথা আমরা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "আরণ্যক" উপন্যাসে পড়েছি | তবে সেই অনুভূতি সত্যি রোমে রোমে হর্ষ জাগায় কিনা তা জঙ্গলের ভিতর রাত্রিযাপন না করলে হয়ত জানতেই পারতাম না | হাওড়া থেকে মহারাষ্ট্রগামী ট্রেন ধরে ভোর টা নাগাদ আমরা অবতীর্ণ হই নাগজিরা নিকটবর্তী গুন্ডিয়া স্টেশনে  যা  নাগজিরা থেকে ৪৫ কিমি দূরে অবস্থিত| সেখান থেকে আমরা চারটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে টাটা সুমোতে চেপে রওনা হলাম নাগজিরা ফরেস্টের উদ্যেশ্যে | শুরু হলো আমাদের অরণ্যযাত্রা, বাজার-দোকানপাঠ-লোকালয়-জনবসতি পেরিয়ে প্রকৃতি মায়ের কোলে উত্তীর্ণ হওয়ার এক সাধনা | স্টেশন চত্বর থেকে রাস্তা ধরে এগোতে থাকি, অবলুপ্ত হতে থাকে বাড়িঘর, জনমানব; আবির্ভূত হয় শাল-সেগুন-দেবদারু-আমলকির গগনচুম্বী শুস্ক উদ্ভিতের রাশি রাশি সারি | পরিচয় হয় সেই বনে বসবাসকারী এক প্রকার প্রজাতির বানরের সাথে, স্থানীয় নাম "লাঙ্গুর"| বুঝতে পারি আমরা সেই গহন অরণ্যের খুবই নিকটে | অবশেষে এসে উপস্থিত হই নাগজিরা ফরেস্টে |


মধ্যানের ভোজন গ্রহণ করে বেরিয়ে পড়ি জঙ্গল সাফারির উদেশ্যে | দুইপাশে বিস্তীর্ণ গাছের সারি, তার মাঝে এঁকেবেঁকে চলেছে অনন্ত রাস্তা; তারই মাঝে পথ পেরিয়ে চলে বেড়াচ্ছে হরিণ পাল, ডালে ডালে খেলছে লাঙ্গুর দল | কিছুটা পথ টাটাসুমোতে যেতেই চোখে পড়ে শ্যামল অরণ্যে নীলের ছটা | কাছে যেতে দেখি ৩টে ময়ূর ময়ূরী ছোটাছুটি করছে সেই সাথে আকাশে নানাবিধ পাখির কিচির মিচির | স্থানীয় গাইডের সহায়তায় আমরা সেই সমস্ত পাখির নাম জানলাম | পরিচয় হল আরো অনেক প্রাণীর সাথে, যথা বনমুরগী, বন্যকুকুর, বাইসন, নীলগাই আর ছিল এক পোষ্য হাতি, যে রোজভোরে তার মাহুতের সাথে জঙ্গলের মাঝে এক বিস্তীর্ণ ঝিলে স্নান করতে আসত আর বেলায় আমাদের ডরমেটরি বা কিচেনের আশেপাশে ঘুরে বেড়াত

তবে জঙ্গলের গাছ হল, পাখি হল, জীবজন্তুও হল , কিন্তু জঙ্গল বা অরণ্য বলতে যা সবার প্রথম মাথায় আসে তা হল, বাঘ-ভাল্লুক-সিংহ | জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে এনাদের সাথে দেখা না হলে কি বেড়ানোটা সার্থক হয়? না হয় না | যেন সব কিছুর পরেও " incomplete " শব্দটা ব্যবহার করতে হয় | আমাদের পরম ইচ্ছা এবং স্বয়ং ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমাদের এই অরণ্যযাত্রা অসম্পূর্ণ তথা ইনকমপ্লিট থাকেনি |

নাগজিরায় পরপর দুদিন ৩টে সাফারির মাধ্যমে জানতে পারি এই Nagzira Willife Santuary
১৫২/৪১ বর্গ কিমি জায়গা জুড়ে বিসতৃত এবং প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত, ওল্ড নাগজিরা এবং নিউ নাগজিরা ওল্ড নাগজিরা- জনগণের প্রবেশাধিকার আছে, যদিও পায়ে হেঁটে নয় ; কিন্তু নিউ নাগজিরা- প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ | দুই নাগজিরা মিলিয়ে বাঘের সংখ্যা ছিল টি (২০১৪ সালের তথ্য অনুযায়ী) |

প্রথমদিনে সাফারির অন্তিমপর্বে আমরা যখন প্রায় হাজার হাজার হরিণ লাঙ্গুর দেখে মোটামুটি ক্লান্ত ঠিক সেই সময় প্রকৃতির এক আকষ্মিক পরিবর্তন ঘটে | শোনা যায় জীবজন্তুর প্রাণ বেগে দৌড়ানোর শব্দ, গাছে গাছে ফেউয়ের ডাক যাকে বলে অ্যালার্ম কল | কথিত আছে বাঘ শিকারে বেরোলে এক  বিশেষ প্রজাতির বানর অন্য প্রাণীদের সাবধান করার জন্য এক বিশেষ শব্ধ করে ডেকে চলে অনবরত | আমাদের গাড়ি সেই ডাককে কম্পাস বানিয়ে ছুটতে থাকে সেই মাংসাশীর খোঁজে | তবে অনেক খোঁজার পরও তার দেখা মেলেনা | ইতিমধ্যে জানতে পারি অন্য গাড়ির বন্ধুরা তাকে দেখে ফেলেছে | কিছু সময় অপেক্ষা করে এক বনবিভাগের কর্মীর সহায়তায় সঠিক দিক নির্দেশনার মাধ্যমে খুঁজে পাই সেই জীবটিকে | দুচোখ ভরে দেখলাম তাকে; প্রথমে যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, চিড়িয়াখানার সেই লোহার খাঁচা বা পরীখা কিছুই নেই তাকে দেখার মাঝে, সে বসে আছে জঙ্গলের রাস্তার মাঝে | বিকালের পরন্ত রোদ তার গায়ে পরে চিকচিক করছে হলদে-কালো ডোরা কাটা দাগগুলি | সে বেরিয়েছে শিকারে | তাই রাস্তা আটকে বসে থাবা চাটা তার শিকারের প্রারম্ভিক ধাপ |গাইড জানান তার বয়স আড়াই বছর যদিও দেখে বোঝার উপায় নেই | আকার আকৃতিতে সে পূর্ণাঙ্গ রয়েল বেঙ্গল টাইগার | তার নাম জয় তার এক সমবয়সী ভাই আছে, নাম বীরু | এই জয় আর বীরুই নাকি জঙ্গলের সর্দার তবে ঠাকুর বা গব্বর কেউ নেই | কিছুক্ষন থাবা চাটার পর উঠে দাঁড়িয়ে জয় হাঁটতে শুরু করল, সাথে সাথে স্টার্ট দিল আমাদের গাড়ি | শুরু হল অনুসরণের পথ| প্রায় কিমি পথ চলার পর জঙ্গলের বাঘ জঙ্গলেই মিলিয়ে গেলো| সার্থক হল আমাদের যাত্রা |

সার্থক এক্সকারশন | তবে আমাদের এই যাত্রার ক্লাইমাক্সটা একটু অন্যরকম হয়েছিল | বিদ্যুৎহীন এই জঙ্গলে রাত কাটানো, রাত বাড়লেই অ্যালার্ম কলের তীব্রতা প্রতিটি রাতের ঘুমকে বিচলিত করেছিল| নেই সেখানে কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক , এত প্রতিবন্দকতার পরেও জয়কে স্মরণ করলে একটা কথাই মনে আসে "মহারাজা| তোমারে সেলাম |" তবে সার্থকতো বুঝলাম সেই সার্থকতার চূড়াটা কতটা হতে পারে তা সেদিন কেউই আঁচ করতে পারিনি| ব্যাপারটা অনেকটা 'কাহানি মে টুইস্ট ' এর মতো |প্রথমদিনে প্রথম সাফারির অনবদ্য উপহার ছিল জয় কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় সাফারিতে সেই হরিণ লাঙ্গুর ময়ূর দেখেই কেটে গেছিল| সাফারি শেষ করে ডরমেটরিতে ফিরছি হটাৎ শুনতে পেলাম সেই রম খাড়া করা অ্যালার্ম কল | অনুমান করলাম 'তাহলে কি আবার'? গাইড ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল গাড়ি ঘোরানোর | গাড়ির সাথে আমরাও চললাম মরীচিকার সন্ধানে | কিন্তু আফসোস ! কেউ নেই না জয়, না বীরু | বিমর্ষ মুখে সবাই ফিরে আসছি | হঠাৎ চোখে পড়ে ধেয়ে রাস্তা পার হচ্ছে এক প্রাণী গায়ে তারও হলুদের ওপর কালো ছোপ ছোপ দাগ , সবার ম্লানমুখে দেখা যায় হাসির ঝিলিক | গাড়ির সবাই একসাথে চিৎকার করে ওঠে " ওই তো রে ! ওটা টো লেপার্ড"! বাংলায় যাকে বলে চিতাবাঘ যা দেখার সুযোগ শুধু আমাদের গাড়িরই হয়েছিল | যা অন্যদের ঈর্ষানিত করেছিল, আমাদের করেছিল গর্বিত | সমাপ্ত আমাদের অরণ্য অভিযান |

জঙ্গলে যে কতটা সুন্দর, কতটা গম্ভীর , কতটা ভয়ঙ্কর তা এখানে না এলে কোনোদিন বুঝতাম না | জঙ্গলে রাতের আকাশে শত শত তারা হাজার ওয়াটের আলোর থেকে কতটা সুন্দর কতটা অপূর্ব তা ভাষায় প্রকাশ করা শুধু  দুস্কর নয় অসম্ভব বটে | তাই এইরূপ সুখ্যাতিসূক্ষ্য অনুভূতি লাভের জন্য, প্রকৃতির এই রূপ-সৌন্দর্য্য আকণ্ঠ পানের জন্য আমি আমার বাবা-মা, শিক্ষক মহাশয়গন এবং আমার ক্লাসমেটদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব, যাদের সাহায্য ছাড়া আমি প্রকৃতির এই অগাধ সৌন্দর্য্য গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হতাম |শেষ কৃতিত্বটা 'জয়' আর নাম না জানা 'লেপার্ড ' কেই দিতে হয়, তারা দুজন না থাকলে সত্যি জঙ্গলটা জঙ্গল হয়ে উঠতো না কখনো!!

2 comments: